ডেঙ্গুজ্বর এর কারণ , লক্ষণ ও চিকিৎসা
ডেঙ্গুজ্বর এর কারণ , লক্ষণ ও চিকিৎসা
বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে ক্রমাগত বাড়ছে। এডিস মশার কামড়েই ডেঙ্গুজ্বর হয়ে থাকে , অন্যান্য মশা কামড়ালে নয় । আবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ানো মশা অন্য কাউকে কামড়ালে তার মধ্যেও ডেঙ্গু ছড়ায় । যাইহোক, প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা না হলে, ডেঙ্গু মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
অপরদিকে এখন চলছে করোনা মহামারী । তাই জ্বর উঠলেই করোনা হয়েছে মনে করেন অনেকেই , কিন্তু তার ডেঙ্গু হবার সম্ভাবনা ও থাকতে পারে । এক্ষেত্রে প্রথমেই উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো জেনে নিন
সাধারণ ডেঙ্গুজ্বরঃ
১) ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর হতে পারে । সাথে প্রচুর মাথাব্যথা হয়। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে। বিশেষ করে শরীরের হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থি সন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা হয়। তীব্র পেটে ব্যথাও হতে পারে।
২) ডেঙ্গুজ্বরে বিশেষত চোখের পিছনে তীব্র ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে চোখে ঝাপসা দেখা যায় ।
৩) জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো।
৪) পাশাপাশি বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে।
৫) রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়।
বিশেষ ধরনের (হেমোরেজিক) ডেঙ্গুজ্বরঃ
এই পর্যায় হলো ডেংগুজ্বরের ভয়াবহ পর্যায় । এই জ্বরে সাধারণ ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরও জটিল ও ভয়াবহ লক্ষণগুলো দেখা দেয় । যথাঃ
১) জ্বর , গায়ে ব্যথার সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন- নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হয় । এছাড়া ও চামড়ার নিচে রক্ত জমা, মাড়ি ও দাঁত থেকে রক্ত পড়া, কফের সঙ্গে রক্ত বা রক্তবমি হতে পারে। পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বের হতে পারে বা কালো পায়খানা হতে পারে । চোখের মধ্যে এবং চোখের বাহিরে ও রক্ত দেখা দিতে পারে ।
২) হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে কখনো কখনো বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস হয়। আবার কিডনী আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেওয়ার প্রমাণ ও মিলেছে কিছু ক্ষেত্রে ।
৩) মহিলাদের ক্ষেত্রে অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
শক সিনড্রোমঃ
ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের সঙ্গে সার্কুলেটরী ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণগুলো হলো যথাক্রমে , রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া , নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হওয়া, হাত পা ও অন্যান্য অংশ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওইয়া ইত্যাদি । রোগী হঠাৎ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। দ্রুত জ্ঞান ফিরে না এলে মৃত্যু পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।
করোনার সাথে ডেঙ্গুর পার্থক্যঃ
বাংলাদেশের একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলছিলেন, ডেঙ্গু জ্বর এবং কোভিড-১৯- দুটোই ভাইরাসজনিত রোগ হলে দুটোর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।
এমনকি একই রোগী কোভিড এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।
‘ডেঙ্গু এবং করোনাস উভয় ক্ষেত্রেই জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি, কাশিএবংস্বাদনাথাকাহতেপারে।
তবে, করোনার ক্ষেত্রে নাকে ঘ্রাণ পায় না এবং কারো কারো পাতলা পায়খানা হয়, যেটা ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে হয়না– বলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।
এছাড়া করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হতে পারে, যেটি ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে হয় না বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে চার–পাঁচ দিন পরে শরীরে লাল অ্যালার্জির মতো র্যাশ হতে পারে। তখন রক্তে প্ল্যাটিলেটের মাত্রা কমে যেতে পারে। করোনার ক্ষেত্রে শরীরে লাল র্যাশ হয় না ।
ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে ‘শক সিন্ড্রোম’ হতে পারে যেটি রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়।
‘কিছু লক্ষণ আছে যেগুলো থাকলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সেগুলোর মধ্যে যদি দেখা যায় যে রোগীর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। অথবা তার কালো পায়খানা হচ্ছে।’
ডাক্তার শর্মিলা হুদা বলছেন, গুরুতর ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে নারীদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তচাপ কিংবা হঠাৎ করে মাসিক হতে পারে, যেটি করোনার ক্ষেত্রে হয় না ।
চিকিৎসাঃ
ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই । প্রাথমিক অবস্থায় সাধারণ জ্বরের মত চিকিৎসা দেয়া হলেও হেমোরেজিক রোগীর লক্ষনসমূহ অনুধাবন করে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন । তবে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঘরোয়া পদ্ধতিতে বা হাতুড়ে ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করানোর চেষ্টা না করাই ভালো । রোগীর কালো পায়খানা হলে বা নাকমুখ দিয়ে বা শরীরের যে কোন জায়গা দিয়ে রক্ত বের হলে তাকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে । আশার বিষয় হলো, বাংলাদেশের ১২জন গবেষক ও চিকিৎসক , ১০১জন ডেঙ্গু রোগীর ওপর গবেষণা করে “অ্যালট্রোমবোপাগ” ওষুধটির সাফল্যের চিত্র দেখতে পেয়েছেন। তাদের ২৫ মিলিগ্রাম করে ওষুধটি দেয়া হয়েছিল।
গবেষকদের একজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সজীব চক্রবর্তী বলেছেন, “ডেঙ্গু রোগের একটি অন্যতম উপসর্গ হলো এতে রক্তের প্লেটলেট কমে যায়। কিন্তু অ্যালট্রোমবোপ্যাগ নামের একটা ওষুধ রয়েছে যা রক্তের প্লেটলেট বাড়ায়, যেটা এই ১০১ জন রোগীদের উপর প্রয়োগ করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি ।“
যাইহোক, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মসার উৎস নিধন ও মশারী টাঙিয়ে ঘুমানোই সবচাইতে কার্যকর পন্থা – এমনটাই অভিমত ডাক্তারদের ।
ডেঙ্গু জ্বর চলাকালীন করণীয়ঃ
১) যে কোন খাবার ই খেতে পারবেন । তবে, স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খাবার খাবেন। যেমন- খাবার স্যালাইন, টাটকা ফলের রস ইত্যাদি। এ ছাড়াও ডাবের পানি, ভাতের মাড়, গ্লুকোজ, বার্লি, দুধ, হরলিকস, বাসায় তৈরি স্যুপ ইত্যাদি খাওয়া প্রয়োজন ।
২) শরীরকে চাপমুক্ত রাখার জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। জ্বর ভালো হয়ে গেলেও আর এক সপ্তাহ পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে ।