গর্ভবতী মা

গর্ভবতী নারীর শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গেই পরিবর্তন ঘটে

গর্ভবতী নারীর শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গেই পরিবর্তন ঘটে

শরীরের ভেতরে একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে, কিছুদিন পরে তাকে নিজের দুই হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন, বুকে জড়িয়ে ধরবেন, তার চোখ, কান, নাকে হাত বোলাবেন, এই আবেগ থেকে গর্ভাবস্থায় শরীরের যত জটিলতা সব ভুলে গিয়েছিলেন ফারজানা ভুঁইয়া।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ২০১৯ সালে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, শুরুর দিকে যেটা হয়েছিল, আমার খেতে ইচ্ছা করতো না। খাবারের রুচি চলে গিয়েছিল। সারাক্ষণ মাথা ব্যথা থাকতো। আর কোনকিছু ভালো লাগতো না।

এরপর ধীরে ধীরে শরীরের পরিবর্তন খেয়াল করতে শুরু করলেন তিনি।

চারমাসের মাথায় খেয়াল করলাম পেট বড় হয়ে যাচ্ছে। আমার পেট অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে ওজন বাড়তে থাকলো। শেষের দিকে এসে খুব কষ্ট পেয়েছি। রাতে ঘুমাতে পারতাম না ওজনের কারণে পিঠে ব্যথা করতো। দেখা যেত যে আধাঘণ্টা হয়ত ঘুমিয়েছি পিঠের ব্যথায় আবার উঠে একটু হাঁটতে হতো। বারবার টয়লেট চাপত।

ফারজানা ভুঁইয়া বলছেন, তিনি সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন এই আকাঙ্ক্ষা থেকে যে আর কয়দিন পরই তার শরীরের ভেতরে বেড়ে ওঠা প্রাণটিকে জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন।

গর্ভাবস্থায় শরীরের সামনের অংশ বেড়ে যাওয়ার কারণে পিঠের হাড়ে চাপ তৈরি হয়।

শরীরের নানা পরিবর্তন আমি সামাল দিতে পারবো কিনা, ধকল সামলে উঠতে পারবো কিনা, সে নিয়ে প্রথম দিকে মনের মধ্যে ভয় কাজ করতো। কিন্তু পরের দিকে যখন মনে পড়তো যে আমার শরীরের ভেতরে একটি প্রাণ বড় হচ্ছে, যে মাঝে মাঝে নড়ে উঠে জানান দেয়, সে সামনে আমার জীবনে আসতে যাচ্ছে। তাকে ধরতে পারবো, অনুভব করতে পারবো, তখন একটা ভাল লাগার অনুভূতি কাজ করতো। তখন ভয়টা কেটে যেত।

গর্ভাবস্থায় দুটো বিষয় পছন্দ করতে পারেননি ফারজানা ভুঁইয়া তার একটি হল ওজন বেড়ে যাওয়া আর ‘স্ট্রেচ মার্ক’, ত্বকের উপর লম্বা সাদা দাগ, দেখে মনে হয় যেন ত্বক ফেটে গেছে।

গর্ভবতী নারীর পেট, নিতম্ব, ঊরু, স্তন – এসব অংশে এমন ‘স্ট্রেচ মার্ক’ হতে পারে। অনেক সময় সন্তান জন্মদানের পরও দীর্ঘদিন এই দাগ রয়ে যায়। ফারজানা ভুঁইয়ার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

গর্ভাবস্থায় শরীরের যত পরিবর্তন

 

নতুন একটি প্রাণের জন্মদানের জন্য নয় মাস বা তার কিছু বেশি সময় ধরে একজন গর্ভবতী নারী যখন তাকে জঠরে বহন করেন, ধীরে ধীরে একটুখানি রক্তপিণ্ড থেকে হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, হাত, পা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি হয়ে একটি ভ্রূণের রূপান্তর হতে থাকে।

সেই সাথে নারীর শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসতে থাকে।

গর্ভাবস্থায় নারীরে শরীরে যত রকম চমক তৈরি হয়, যত ধরনের পরিবর্তন আসে, তার পেছনে রয়েছে এস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন নামে দুটি হরমোন, বলছিলেন গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা বেগম।

তিনি বলছেন, একদম শুরু থেকেই নারীর শরীরে পরিবর্তন আসতে থাকে। প্রথম তিনমাস বাহ্যিক পরিবর্তন বোঝা যায় না।

তিনি বলছেন, বমিবমি ভাব অনেক গর্ভবতী নারী শুরুতে অনুভব করেন, বিশেষ করে সকালের দিকে। এজন্য খেতে পারেন না।

আর যেটি সবার ক্ষেত্রে ঘটে সেটি হল শরীর ভারি হয়ে যাওয়া। প্রতি মাসে দুই কেজি পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি অথবা পুরো গর্ভকালীন সময়ে ১৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়।

এর বাইরেও বেশ কিছু পরিবর্তনের কথা তিনি জানিয়েছেন:

  • গর্ভাবস্থায় নারীর শরীরের হাড়ের সংযোগস্থল ঢিলা হয়ে যায়। হাড়ের সংযোগস্থল ব্যথা হয়।
  • পেট ভারি বা শরীরের সামনের অংশ বেড়ে যাওয়ার কারণে পিঠের হাড়ে চাপ তৈরি হয়। পিঠে ব্যথা হতে পারে।
  • গর্ভবতী নারীদের অনেক সময় রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায় যাকে বলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। বেশিরভাগ সময় সন্তান প্রসবের পর এটি চলে যায়।
  • দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, ব্রাশ করার সময় রক্ত বের হওয়া, মাড়িতে ব্যথা হতে পারে।
  • জরায়ুর আকার বড় হয়ে যাওয়ার কারণে মূত্র থলিতে চাপ পড়ে। তাই বারবার প্রস্রাব হয়।
  • জরায়ুর আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় ফুসফুস পর্যাপ্ত প্রসারিত হতে পারে না। তাই অনেকের শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে কারণ শরীরে আয়রনের চাহিদা বাড়ে।
  • এসময় নারীর শরীরে তরল উৎপাদন বেড়ে যায়। এতে পায়ে পানি জমে ফোলাভাব হতে পারে।
  • অনেকের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
  • হরমোনের কারণে স্তন আকারে বড় হতে থাকে, স্তনবৃন্তের আশপাশ আরও কালো হয়ে ওঠে। শিশুকে খাওয়ানোর জন্য স্তন প্রস্তুত হয়। অনেকে স্তনে ব্যথা অনুভব করেন।
  • ল্যাকটোজেন হরমোন বুকের দুধ তৈরি করে।
  • যৌনতায় আগ্রহ বেড়ে যেতে পারে অথবা একদম কমে যেতে পারে।
  • যোনিপথ দিয়ে সাদা স্রাব যেতে পারে, রক্তক্ষরণ হতে পারে যা অতিরিক্ত না হলে উদ্বেগের কিছু নেই।

গর্ভবতী নারীর আবেগে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়।

এগুলোই সাধারণ গর্ভাবস্থার প্রধান শারীরিক পরিবর্তন। যা সকল নারীর ক্ষেত্রে একই রকম নয়।

প্রসবের পর অক্সিটোসিন হরমোন জরায়ুকে সংকুচিত করে।

তবে অনেককিছুই তার আগের জায়গায় ফিরে যায় না। অনেকের ওজন, স্ট্রেচ মার্ক, ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়ে যায়।

 মনে যে ধরনের প্রভাব পড়ে

এই যত ধরনের শারীরিক পরিবর্তন তা নারীর মনের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সালমা পারভিন বলছেন, এসময় উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, মন খারাপ, রাগ, ঘনঘন মেজাজ বদল এরকম অনেক কিছু ঘটে নারীর মনে।

অনেকে আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তারা খুব অল্পতেই কেঁদে ফেলেন, বিরক্ত হন, রেগে যান, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।

তিনি বলছেন, গর্ভবতী নারীর আবেগে বড় ধরনের পরিবর্তন হয় কারণ কিছুই আর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। কোনদিন শরীর ভাল থাকে আবার পরদিন দেখা গেল শরীর খারাপ লাগছে। শরীরের অবস্থার এই যে ওঠানামা এটা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। মন চাইলেই সে অনেক কিছু করতে পারছে না। একটা বন্দিত্বের অনুভূতি তৈরি করে।

 প্রিয়জনের সহায়তা গর্ভবতী নারীর জন্য খুবই জরুরি।

নয় মাসের গর্ভকালীন সময় কেমন যাবে, একটি সুস্থ শিশুর জন্ম হবে কিনা সে নিয়ে অজানা আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা কাজ করে। প্রিয়জনের সহায়তা পাচ্ছেন কিনা, জীবনের এই যে আমূল পরিবর্তন এর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টাও অনেক সময় চাপ সৃষ্টি করে, উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়, হতাশা তৈরি করে।

আগে থেকে প্রস্তুতি

সালমা পারভিন বলছেন, আগে থেকে প্রস্তুতি গর্ভাবস্থার সাথে খাইয়ে নিতে অনেক সাহায্য করে।

প্রতি ট্রাইমেস্টারে শরীর ও মনে কি ঘটে এটা আগে থেকে জানা থাকলে অনেক কিছুই অস্বাভাবিক মনে হবে না।

শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে পড়াশুনা করা, এসম্পর্কিত ভিডিও দেখা, সন্তান জন্ম দিয়েছেন এমন কারোর সাথে আলাপ করা, নিজেকে মনের দিক থেকে প্রস্তুত করা যে এটা কিছু দিনের ব্যাপার, দরকারে কাকে কাছে পাওয়া যাবে, কে তাকে কোন কাজে সাহায্য করবে এসব চিন্তা করে রাখা। এসব প্রস্তুতি গর্ভকালীন সময়ে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।

তিনি মনে করেন আগে থেকে পরিকল্পনা করে সন্তান নিলে মানিয়ে নিতে সুবিধা হয়।

গর্ভবতী নারী সঠিক সুসম খাবার গ্রহণ জরুরী।

সালমা পারভিন বলছেন, গর্ভকালীন সময়ে একজন নারীর চারপাশের মানুষজন তাকে বোঝার চেষ্টা না করলে সেটি তার জন্য খুব কষ্টদায়ক হয়ে উঠতে পারে।

বিশেষ করে স্বামীর কাছ থেকে সহযোগিতা, পাশে থাকা, সাহস পাওয়া সবচাইতে জরুরী বলে তিনি মনে করেন।

“সন্তান একজন মায়ের একার না। সন্তান দুই জনের। মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলে, সে যদি নিজের সঠিক যত্ন না নেয় তাহলে তার অনাগত সন্তানের ক্ষতি হবে। স্ত্রীর সুস্থতাই বাচ্চার সুস্থতা এটি স্বামীদের বুঝতে হবে। এমন কিছু তাদের করা উচিত নয় যা গর্ভবতী নারীর জন্য মানসিক চাপ।”

তিনি বলছেন, এর একটি হল যৌন মিলন। গর্ভাবস্থায় একটি সময়ের পর বাংলাদেশে চিকিৎসকেরা যৌন মিলনে নিরুৎসাহিত করে থাকেন।

যদিও ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা এনএইচএস বলছে, কোন শারীরিক সমস্যা না থাকলে গর্ভকালীন যৌন মিলনে সমস্যা নেই।

সালমা পারভিন বলছেন, গর্ভাবস্থায় নারীরা এত কিছুর মধ্যে দিয়ে যায় যে তার কাছে নিয়মিত যৌন মিলন আশা করা উচিৎ নয়। সে যদি না চায় তাহলে তার ইচ্ছার সম্মান করা উচিৎ।

চিকিৎসকের কিছু পরামর্শ

  • গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকার উপায় হিসেবে গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা বেগম কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
  • সঠিক ও সুসম খাবার গ্রহণ। কিছু কাঁচা খাবার এড়িয়ে চলা।
  • নিয়মিত হাঁটা ও গর্ভাবস্থার জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম।
  • গর্ভবতী নারীদের রাতে চিৎ হয়ে শোয়ার বদলে এক পাশে কাত হয়ে শোয়া।
  • গর্ভকালীন সময়ে অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া যদি কোন জটিলতা না থাকে।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়াম ‘সাপ্লিমেন্ট’ গ্রহণ করা।
  • নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা।
  • মন ভালো রাখতে নিজের পছন্দের কিছু, শখের কিছু, শান্তি অনুভব করেন এমন বিষয়গুলো জীবনের সাথে যুক্ত করা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *