গর্ভবতী মা

গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ কেন হয় এবং সুরক্ষায় সতর্কতা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শিশু পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার আগেই মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত হয়ে যাওয়া বিশ্বে খুব সাধারণ একটি ঘটনা হয়ে উঠেছে। প্রতি ১০০ জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে।

গর্ভধারণের প্রথম ২৮ সপ্তাহের মধ্যে যদি কোন শিশুর মৃত্যু হয়, তাকেই মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত বলা হয়ে থাকে। সাধারণত প্রতি ৪টি গর্ভপাতের তিনটি এরকম সময়ে হয়ে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়েও গর্ভপাত হতে পারে। অনেক সময় আপনাআপনি নারীদের গর্ভপাত হয়ে যায়। আবার অনেক সময় স্বাস্থ্য বা অন্য কোন কারণে বাবা-মায়ের ইচ্ছায় গর্ভপাত করানো হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গর্ভপাতের হারের পার্থক্য রয়েছে। তবে প্রতি বছর গর্ভধারণের আট থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে অন্তত ২ কোটি শিশুর এভাবে মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে,সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিয়ে এই মৃত্যুর অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বাংলাদেশে গর্ভপাত

বাংলাদেশের ২০১৪ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, প্রতি বছর অন্তত ১১ লাখ ৯৪ হাজার শিশুর ক্ষেত্রে স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ’ প্রতিদিন গর্ভপাতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৭১টি। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যদিও গর্ভপাত নিষিদ্ধ। তবে সেখানে বলা হয়েছে, মায়ের জীবন রক্ষার প্রয়োজন হলে গর্ভপাত করানো যেতে পারে।চিকিৎসকরা বলছেন, অনেক সময় মায়ের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি হলে চিকিৎসকরা গর্ভপাতের পরামর্শ দেন। আবার অনেক সময় জীবনযাপন, অসুস্থতা, খাবার বা অন্যান্য কারণে আপনাআপনি গর্ভপাতও হয়ে যায়। কিন্তু শুরু থেকে সতর্কতা ও চিকিৎসকের পরামর্শে থাকলে এটি অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব।

প্রতি মুহূর্ত আমার সেই অনাগত সন্তানকে মিস করতাম

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী একজন নারীর পাঁচ বছর আগে মিসক্যারেজ হয়ে যায়। সেই সময় তার গর্ভের সন্তানের বয়স হয়েছিল সাড়ে পাঁচ মাস। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর দেড় মাসের দিকে হালকা রক্তপাত হয়েছিল। কিন্তু আশঙ্কা করার মতো তেমন মনে হয়নি। সেই অবস্থায় আমি নিয়মিত অফিস করেছি, বাইরে ছোটাছুটি করতে হয়েছে, আমার প্রেগন্যান্সির যখন সাড়ে পাঁচ মাস, তখন একদিন আমার কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। হালকা ব্লিডিংও হচ্ছিল। একদিন বাথরুমে যাওয়ার পর মনে হলো, সাদা কি যেন একটা শরীর থেকে বেরিয়ে গেল।

চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, যেখানে বেবি থাকে, তার শরীরের সেই জরায়ুর মুখ খুলে গেছে। তারা সেটা সেলাই দিয়ে আটকে দেয়ার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু বেশিরভাগ অংশটা খুলে যাওয়ায় আর সেটা সম্ভব হয়নি।

আমার বাচ্চাটিকে আর বাঁচানো যায়নি। এরপর আমি মানসিক-শারীরিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রতি মুহূর্ত আমার সেই অনাগত সন্তানকে মিস করতাম।পরবর্তীতে কয়েক বছর পরে আবার তিনি গর্ভধারণ করেন। তবে এবার গর্ভধারণের একেবারে প্রথম থেকেই চরম সতর্কতা অবলম্বন করায় তার শিশুটি সুস্থ সবলভাবে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তার বোনের ক্ষেত্রে চিকিৎসক আগেই গর্ভপাতের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে জরায়ু মুখ সেলাই করে দেন। তার শিশুটিরও সুস্থভাবে জন্ম হয়েছে।

কেন  মিসক্যারেজ হয় ?

গাইনোকলোজিস্ট এবং অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম বলছেন, অনেকগুলো কারণেই মিসক্যারেজ হতে পারে। এর কিছু কিছু কারণ শনাক্ত করা যায়। আবার অনেক সময় বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেলেও কারণটা বুঝতে পারা যায় না।

 চিকিৎসকরা মিসক্যারেজের পেছনে যেসব কারণ দেখতে পেয়েছেন:

  • বাচ্চার জন্মগত ক্রুটি-যেমন গর্ভধারণের সময় যদি ভ্রূণ অনেক বেশি অথবা একেবারে কম ক্রোমোজোম পায়, তখন ভ্রমণ ঠিকমতো তৈরি হয় না। ফলে গর্ভপাত হতে পারে। এর কারণ এখনো বিজ্ঞানীদের জানা নেই। আবার প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল নামের যে অঙ্গের মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে রক্ত সরবরাহ হয়, সেটি গঠনে কোন ক্রুটি থাকলে গর্ভপাত হতে পারে।
  • মায়ের অসুস্থতা যেমন ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, কিডনির সমস্যা। সেই সঙ্গে ওভারঅ্যাকটিভ থাইরয়েড গ্লান্ড বা আন্ডারঅ্যাকটিভ থাইরয়েড গ্লান্ড।
  • মায়ের ইনফেকশন যেমন, রুবেলা, এইচআইভি, গনোরিয়া, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া। সংক্রমণের কারণে গর্ভে পানি ভাঙ্গতে শুরু করে।
  • মায়ের বয়স যদি ৩৫-৩৯ বছরের মধ্যে থাকে, তাহলে প্রতি ১০ জনের মধ্যে দুইজনের মিসক্যারেজের সম্ভাবনা থাকে। আবার ৪৫ বছরের বেশি হলে প্রতি ১০ জনের মধ্যে পাঁচজনের গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে।
  • হরমোনের সমস্যা
  • মা পরিশ্রম বা অতিরিক্ত ভ্রমণ করেন
  • সিগারেট, মদ্যপান বা মাদক নেয়া বা প্রচুর ক্যাফেইন গ্রহণ করা
  • জরায়ুর ত্রুটি, অস্বাভাবিক আকৃতি, টিউমার, উল্টো পজিশনে থাকা
  • ডিম্বাশয়ের আকার স্বাভাবিকের চেয়ে বড় থাকা
  • জরায়ুর আকার অত্যন্ত ছোট থাকা, যেখানে বাচ্চা বড় হতে পারে না
  • একসাথে একাধিক বাচ্চা গর্ভধারণ
  • জরায়ুর মুখ দুর্বল বা খুলে যাওয়া
  • মা, বোন বা ঘনিষ্ঠ স্বজনের মিসক্যারেজের জিনগত ইতিহাস
  • বিষাক্ত খাবার ও ওষুধ
  • স্থূলতা বা অতিরিক্ত মেদ, ওজন
গর্ভ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেকগুলো কারণেই মিসক্যারেজ হতে পারে। এর কিছু কিছু কারণ শনাক্ত করা যায়। আবার অনেক সময় বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেলেও কারণটা বুঝতে পারা যায় না।

কোন লক্ষণ দেখা গেলে মিসক্যারেজের ব্যাপারে সতর্ক  হবেন

গাইনোকলোজিস্ট এবং অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম বলছেন, গর্ভাবস্থায় কখনো কয়েকদিন ধরে সাদা স্রাব বা রক্ত বের হতে শুরু করলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তখন আমরা কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখবো, পেটের ভেতরে শিশুর অবস্থা কি আছে। কোন সমস্যা থাকলে তখনি শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেয়া যায়।

পেটে বা কোমরে ব্যথা হতে শুরু করলে, শিশুর নড়াচড়া কমে গেলেও চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। পরিবারের বা নিজের অতীতে আপনাআপনি গর্ভপাতের ইতিহাস থাকলে বেশি সতর্ক হতে হবে। সেই সঙ্গে যেসব কারণে গর্ভপাতের ঝুঁকি তৈরি হয়, সেসব বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। আগে যদি কখনো গর্ভপাত হয়ে থাকে, তাদের নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। তখন বুঝতে পারা যায় যে, এই বাচ্চার মিসক্যারেজের সম্ভাবনা কতটা। ডায়াবেটিস, স্থূলতা, কিডনির রোগ বা প্রেশার ইত্যাদি থাকলে সেগুলো তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে,সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিয়ে গর্ভাবস্থায় শিশু মৃত্যুর অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

মা ও শিশুর প্রতীকী ছবি

মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের ক্ষেত্রে কি হাসপাতালে যেতে হবে ?

বাংলাদেশে হাতুড়ে চিকিৎসক বা ধাত্রীর মাধ্যমে গর্ভপাত করাতে গিয়ে মৃত্যুর অনেক ঘটনা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।চিকিৎসকরা বলছেন, মা বা বাচ্চার স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হলে গর্ভপাতের জন্য যেকোনো হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া উচিত।

‘অনেক সময় আপনা আপনি মিসক্যারেজ হয়ে যায়। অনেক সময় চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে ওষুধ দিতে পারেন। আবার অনেক সময় এমন হয় যে, বাচ্চা মারা গিয়েও বের হচ্ছে না। আবার কিছুটা বের হয়েছে, কিছুটা ভেতরে থাকে। অনেক সময় ওষুধেই সমাধান হয়, আবার অনেক সময় চিকিৎসককে হয়তো অস্ত্রোপচার করতে হয়, অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম।

তিনি জানান, গর্ভধারণের আট থেকে ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করা হলে মায়ের ঝুঁকি অনেক কম থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধ দিয়ে এটা করা যায়। তবে মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত করা হলেও এর পরবর্তী সময়ে নারীদের পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে এক থেকে দুই মাস সময় লাগে। কিন্তু অনেক সময় মানসিকভাবে তারা ক্ষতির শিকার হন। সঠিক সময়ে সেটা চিকিৎসা করা না হলে দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতার শিকার হতে পারে।

            গর্ভবতী নারীর আবেগে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়।

গর্ভবতী নারীর আবেগে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়।

গর্ভপাতের কতদিন পরে আবার সন্তান নেয়া যাবে ?

একজন নারী গর্ভপাতের কষ্টের কথা বর্ণনা করেছেন, তিনি দুই বছর পরে পুনরায় সন্তান নিয়েছেন। তবে সবার ক্ষেত্রে একই রকম হবে না। এজন্য তার শারীরিক অবস্থা, পূর্বেই ইতিহাস বিশ্লেষণ করে চিকিৎসক পরামর্শ দিতে পারেন। তবে আবার দুর্ঘটনা এড়াতে দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের শুরু থেকেই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত, বলছেন ডা. আনোয়ারা বেগম।

গর্ভাবস্থায় শরীরের সামনের অংশ বেড়ে যাওয়ার কারণে পিঠের হাড়ে চাপ তৈরি হয়।
গর্ভাবস্থায় শরীরের সামনের অংশ বেড়ে যাওয়ার কারণে পিঠের হাড়ে চাপ তৈরি হয়।

গর্ভপাত নিয়ে কিছু ভুল ধারণা

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এনএইচএস বলছে, গর্ভপাত নিয়ে বিশ্বের নারীদের অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে, যার কোন ভিত্তি নেই।

  • উত্তেজনা বা বিষণ্ণতা: যেমন গর্ভধারণের সময় মায়ের মানসিক অবস্থার সঙ্গে গর্ভপাতের কোন সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ তিনি যদি ওই সময় উত্তেজিত বা বিষণ্ণতায় ভোগেন, তা গর্ভধারণে প্রভাব ফেলে না।
  • ভয়:  গর্ভাবস্থায় হঠাৎ ভয় পেলে বা চমকে গেলেও গর্ভপাত হয় না।
  • লিফট বা সিঁড়ি: গর্ভাবস্থায় লিফট বা সিঁড়ি ব্যবহার করলে কোন সমস্যা হয় না।
  • শারীরিক ব্যায়াম: গর্ভাবস্থায় শারীরিক ব্যায়াম করতে বাধা নেই। তবে কতটুকু এবং কীভাবে ব্যায়াম করতে হবে, সেটা চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে।
  • কাজ: গর্ভাবস্থায় চাকরি করার সঙ্গে গর্ভপাতের কোন সম্পর্ক নেই।
  • যৌনতা: গর্ভাবস্থায় যৌন মিলনে কোন বাধা নেই।
  • বিমান ভ্রমণ: গর্ভাবস্থায় বিমান ভ্রমণে বাধা নেই।
  • ঝাল-মসলার খাবার: গর্ভপাতের পেছনে ঝাল-মশলাযুক্ত খাবারের কোন দায় নেই। তবে গর্ভাবস্থায় খাবার সম্পর্কে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া ভালো।
অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনেকের মনে থাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা।

একবার গর্ভপাত হলে কি আবার গর্ভপাত হতে পারে?

গাইনোকলোজিস্ট এবং অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম বলছেন, কারও একবার মিসক্যারেজ হলে যে বারবার সেটা হবে, এরকম কোন ব্যাপার নেই। বেশিরভাগ নারীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একবার মিসক্যারেজ হলেও পরের বার তাদের সুস্থ সবল বাচ্চা হয়েছে। তিনি বলছেন, প্রথমবার যেসব কারণে মিসক্যারেজ হয়েছে, সেগুলো শনাক্ত করে সতর্কতা অবলম্বন করেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঠেকানো সম্ভব।যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এনএইচএস বলছে, মিসক্যারেজ হয়েছে, এরকম প্রতি ১০০ জন নারীদের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে পুনরায় মিসক্যারেজ হতে দেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *