মধুর উপকারিতা, অপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম
মধুর উপকারিতা ও অপকারিতা –
মধু হলো এক প্রকারের ঘন তরল পদার্থ এবং এটির স্বাদ মিষ্টি। মৌমাছি বিভিন্ন ফুলের থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে মৌচাকে সংগ্রহ করে রাখে। মৌমাছির সংগ্রহ করা এই নির্যাস আমরা সাধারনত মধু হিসেবে সেবন করে থাকি। সবার প্রিয় একটি খাবার হল মধু। মধুতে রয়েছে উচ্চ ঔষধি গুণ এবং এটি সর্ব রোগের মহা ঔষধও বটে। প্রতিনিয়ত নিয়ম করে মধু সেবন করলে বহু রোগ থেকে নিরাময় পাওয়া যায়। উচ্চ ওষুধি গুণ থাকার কারণে একাধিক রোগ নিরাময় করতে সক্ষম মধু।
যদি বলা হয় শীতকালে মধুর উপকারিতা কি? তাহলে তা বলে শেষ করা যাবেনা। শীতকালে মধু খেলে বিশেষ উপকার রয়েছে। তবে মধুর একটি বড় গুণ রয়েছে, সেটি হল মধু কখনো নষ্ট হয় না। কয়েক’শো বছর পর্যন্ত এই মধু রাখা যায় এবং তা কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই গ্রহণ করা যায়। জানিয়ে রাখি, মধুতে যদি কোনরকম জীবাণু প্রবেশ করে থাকে, তা এক ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকতে পারে না। কারণ এতে চিনির উচ্চ ঘনত্বের কারণে প্লাজমোলাইসিস প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু মারা যায়।
মধুর পুষ্টি উপাদান
০১। প্রায় ৪৫ টি খাদ্য উপাদান রয়েছে মধুতে।
০২। ফুলের পরাগ থেকে সংগ্রহ করা মধুতে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ পাওয়া যায়।
০৩। এছাড়াও ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ পাওয়া যায় মধুতে।
০৪। ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ পাওয়া যায়।
০৫। এর পাশাপাশি ৫ থেকে ১২ শতাংশ মন্টোজ পাওয়া যায়।
০৬। এছাড়াও এই মধুতে পাওয়া যায়, ২২ শতাংশ অ্যামাইনো এসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ ০৭। এবং ১১ ভাগ এনজাইম।
০৯। ১০০ গ্রাম মধুতে ২৮৮ ক্যালরি পাওয়া যায়।
১০। মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি ১, ভিটামিন বি ২, ভিটামিন বি ৩, ভিটামিন বি ৫, ভিটামিন বি ৬,
আয়োডিন, কপার সহ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান।
১১। মধুতে কোন রকম চর্বি ও প্রোটিন নেই।
মধুর উপকারিতা
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির দিক থেকে মধুর ভূমিকা অতুলনীয়। মধুতে রয়েছে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান যা রোগ প্রতিরোধকারী শক্তি বাড়িয়ে তোলে এবং কোন রকম সংক্রমণ থেকে দেহেকে রক্ষা করে।
হজমে মধুর উপকারিতা
মধুর মধ্যে যে পরিমাণ শর্করার রয়েছে তা খুব সহজেই হজম করতে সাহায্য করে। মধুতে রয়েছে ডেক্সট্রিন। এটি সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া শুরু করে। যার ফলে খাবার খাওয়ার পর বদ হজম, গলা বুক জ্বালা ইত্যাদি সমস্যা দূর হয়।
রক্তশূন্যতা
মধুতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ। যেগুলি রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠন করতে সহায়তা করে। রক্তশূন্যতায় বেশ উপকারী একটি উপাদান হল মধু।
কোষ্ঠকাঠিন্য
মধুতে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স রয়েছে। যা কোষ্ঠকাঠিন্যর মতো সমস্যা দূর করতে সক্ষম। প্রতিনিয়ত যদি খালি পেটে মধু সেবন করা যায়, তাহলে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অম্লত্ব দূরে থাকে।
ডায়রিয়া
মধুতে বি কমপ্লেক্স রয়েছে। যা ডায়রিয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। যাদের বারবার পেট খারাপের প্রবণতা রয়েছে তারা প্রতিনিয়ত খালি পেটে মধু সেবন করতে পারেন।
অনিদ্রায় মধুর উপকারিতা
ঘুমের দিক থেকে মধুর উপকারিতা অপরিসীম। মধুকে ঘুমের ঔষুধ বলা যায়। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস জলের সঙ্গে দুই চামচ মধু মিশিয়ে খেলে রাতে গভীর ঘুম হয়।
অম্বলের সমস্যা
প্রতিনিয়তঃ যদি সকাল বেলায় খালি পেটে খাঁটি মধু সেবন করেন, তাহলে অম্বল এর মতো সমস্যা এবং মুখে টক ভাব দূর হয়ে যায়।
অরুচি
যে সকল ব্যক্তি রয়েছেন, খেতে বসলে খেতে পারেন না। তাদের জন্য মধু খুবই প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত মধু সেবন করলে হজম শক্তি বাড়িয়ে তোলে। যার ফলে খাবার চাহিদা বেড়ে ওঠে। তাই প্রতিনিয়ত নিয়ম করে মধু সেবন করুন।
ওজন কমাতে মধুর উপকারিতা
মধুতে কোন রকম চর্বি ও প্রোটিন নেই। যার ফলে প্রতিনিয়ত মধু সেবন করলে পেট পরিষ্কার হয় এবং চর্বি কমে। যার ফলে ওজন কমে।
দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধিতে
দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধিতে মধুর ভূমিকা অতুলনীয়। প্রতিনিয়ত নিয়ম করে যদি গাজরের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খাওয়া যায় তাহলে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়।
যৌন দুর্বলতা দূর করে
যৌন দুর্বলতা দূরীকরণে মধুর ভূমিকা অপরিসীম। যেসকল পুরুষের যৌন দূর্বলতা রয়েছে তারা প্রতিনিয়ত মধু ও ছোলা মিশিয়ে খান। নিয়মিত এটা খেতে থাকলে কয়েকদিনের মধ্যেই এর উপকার বুঝতে পারবেন। পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম মধু।
দেহে পানিশূন্যতায়
ডায়রিয়া হলে দেহের অধিকংশ জল দেহ থেকে নিঃসৃত হয়ে যায় এবং পানিশূন্যতার মতো সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে ডায়রিয়া হলে প্রতি লিটার জলে ৫০ মিলিলিটার মধু মিশিয়ে খেলে পানিশূন্যতা রোধ করা যায়।
তাপ উৎপাদনে মধুর উপকারিতা
শীতকালে শরীর গরম রাখতে মধুর ভূমিকা অতুলনীয়। শীতকালে রাতের বেলায় যদি দুই চামচ মধু খাওয়া যায় তাহলে শরীর তাজা থাকে এবং শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
হার্টের জন্য মধুর উপকারিতা
প্রতিনিয়ত এক চামচ মৌরি গুঁড়োর সঙ্গে দুই চামচ মধুর মিশ্রণ করে খেলে হৃদরোগের মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও হৃদপেশিকে সবল করে এবং কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। তাই যারা হূদরোগে আক্রান্ত তারা প্রতিনিয়ত এক চামচ মৌরি গুঁড়োর সঙ্গে দুই চামচ মধুর মিশ্রন করে খেতে পারেন।
রক্ত পরিষ্কার করে
মানব দেহের রক্ত পরিষ্কার করতে সক্ষম মধু। নিয়মিত সকাল বেলায় খালি পেটে এক গ্লাস গরম জলের সঙ্গে দুই চামচ মধু এবং এক চামচ লেবুর রস মিশিয়ে খান। এটি সকালবেলায় পেট খালি করার পূর্বে খেলে ভালো কাজ করে। এই মিশ্রন রক্ত কনা গুলিকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মধু। প্রতিনিয়ত যদি দুই চামচ মধুর সঙ্গে দুই কোয়া রসুন খাওয়া হয়। তাহলে ধীরে ধীরে শরীরের উচ্চ রক্তচাপ কমে। এটি প্রতিদিন সকাল বেলায় খালি পেটে সেবন করলে এর উপকারিতা আরও বেশি পাওয়া যায়।
হাঁপানি রোধে মধু
দুই চামচ মধুর সঙ্গে ০.৫ গ্রাম গোলমরিচের গুঁড়া এবং তারই সঙ্গে পরিমাণমতো আদা মিশিয়ে খেলে হাঁপানি রোগ প্রতিরোধ করা যায়। এই মিশ্রণটি দিনে তিনবার খেতে পারলে এর উপকারিতা বেশি পাওয়া যায়।
গলার স্বর সুন্দর করতে মধুর উপকারিতা
মধুর মতো গলার কন্ঠ তৈরি করতে মধুর ভূমিকা অতুলনীয়। আপনি যদি প্রতিনিয়ত মধু সেবন করেন, তাহলে আপনার গলার স্বর সুন্দর এবং মধুর হয়ে ওঠে।
হাড় ও দাঁতের গঠনে মধুর উপকারিতা
মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। এই ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড় মজবুত করে তোলে। চুলের গোড়া শক্ত রাখে, এছাড়াও নখ উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে এবং ভঙ্গুরতা রোধ করে।
রক্ত উৎপাদনে মধুর উপকারিতা
রক্ত উৎপাদনকারী উপকরণ হল আয়রন। আর এই আয়রন প্রচুর পরিমাণে রয়েছে মধুতে। যার ফলে দেহের লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা সহ রক্তের ইত্যাদি উপাদানগুলিকে অধিক কার্যকর ও শক্তিশালী করে তোলে মধু।
তরুণ্য ধরে রাখে
তরুণ্য ধরে রাখতে মধুর ভূমিকা অপরিসীম। মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা ত্বকের রঙ এবং সৌন্দর্য ধরে রাখে। উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং দেহে বয়স্ক ছাপ পড়তে দেয় না। যার ফলে মধু সেবন করলে তরুণ্য ধরে রাখা যায়।
পাকস্থলীর ক্ষমতা বৃদ্ধি
মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে উচ্চ ওষুধিগুন। যার ফলে প্রতিনিয়ত মধু সেবন করলে হজমের সমস্যা দূর হয় এবং পাকস্থলীর কাজ জোরালো হয়। দেহের হাইড্রোক্রলিক অ্যসিড ক্ষরণ কমাতে সক্ষম মধু। নিয়মিত মধু সেবন করলে বুক জ্বালা, অরুচি, বমি ভাব এর মত সমস্যাগুলো দূর হয়।
সর্দি কাশি কমাতে মধুর উপকারিতা
ঠান্ডা ও সর্দি কাশি থেকে নিরাময়ের পেতে মধুর ভূমিকা অতুলনীয়। প্রতিনিয়ত দুই চামচ করে মধু খেলে ঠান্ডা ও সর্দি কাশি নিরাময় হয়।
মধুর উপকারিতা ও অপকারিতা এবং মধু খাওয়ার নিয়ম জেনে নিন
খাঁটি মধু চেনার উপায়
মধু কিনতে গিয়ে আমরা অনেক সময় প্রতারণার শিকার হই। খাঁটি মধু বলে আমাদেরকে বিক্রেতা ভেজাল মধু আমাদেরকে দেন। তবে কিভাবে আপনি চিনবেন খাঁটি মধু? খাঁটি বা বিশুদ্ধ মধু চেনার কয়েকটি উপায় নিন্মে তালিকাভুক্ত করে দেওয়া হল –
খাঁটি বা বিশুদ্ধ মধু কখনো জলের সঙ্গে মিশে যাবে না।
খাঁটি মধু অত্যন্ত আঠালো প্রকৃতির হয়ে থাকে।
খাঁটি মধু সামান্য ঘন হয়। যদি বেশি ঘন হয় তাহলে সেই মধুতে চিনি মেশানো হয়েছে।
খাঁটি বা বিশুদ্ধ মধু কোন পাত্রে রেখে দিলে কখনও নিচে জমাট বাঁধে না।
আঙুলের মাথায় মধু রাখলে যদি সেটা একটি বিন্দুর মতো স্থির হয়ে থাকে, তাহলে সেটা খাঁটি বা বিশুদ্ধ মধু।
এক টুকরো সাদা কাপড়ে ভালো করে মধু মাখিয়ে নিন এবং তা কিছুক্ষণ রাখার পর জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। যদি ওই সাদা কাপড়ে কোন দাগ না থাকে তাহলে বুঝতে হবে সেটি খাঁটি বা বিশুদ্ধ মধু। আর যদি সাদা কাপড়ে দাগ থেকে যায় তাহলে বুঝতে হবে এটি ভেজাল মধু।
মধু খাওয়ার নিয়ম
মধু পছন্দ করেনা এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর। মধু জিনিসটা সবারই প্রিয়। যেহেতু এটা মিষ্টি একটি খাবার তাই এটা সকলেই সেবন করে থাকেন। কিন্তু মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম কি আপনি জানেন? মধু খাওয়ার সাথে সাথে মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম জেনে মধু খেলে একাধিক উপকার পাবেন। তাহলে আর দেরি না করে এক নজরে দেখে নিন মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম –
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গরম জলের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খাওয়ার কথা বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতেও গরম জলের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। কিন্তু মধুর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর উপরে পৌঁছালে মধু বিষাক্ত হয়ে যায়। তাই সবসময় খেয়াল রাখতে হবে গরম জলের সঙ্গে মধু মিশিয়ে সেবন করার সময় জল যেন বেশি গরম না হয়।
- সকাল বেলায় খালি পেটে মধুর সঙ্গে হালকা গরম জল মিশিয়ে সেবন করলে শরীর সুস্থ ও সবল থাকে এবং শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে মধু। তাই প্রতিনিয়ত সকালবেলায় মধু খেলে এর উপকার বেশি পাওয়া যায়। সবসময় মনে রাখতে হবে জল যেন বেশি গরম না হয়। কারণ মধু তাপমাত্রার স্পর্শ পেলেই বিষাক্ত হয়ে ওঠে।