স্বাস্থ্য শিক্ষাঙ্গন

তীব্র শিক্ষক সংকট, পাঠদানে বিপর্যয় !

সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পাঁচ বছরের এমবিবিএস (ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি) কোর্সে তীব্র শিক্ষক সংকট চলছে। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রমের স্বাভাবিক গতি।

শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিক্ষা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নিশ্চিত হচ্ছে না গুণগত মান। চিকিৎসক তৈরির নামে জোড়াতালির পাঠদানে স্বাস্থ্য খাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ কলেজগুলোতে পাঠদানে এক রকম বিপর্যয় নেমে এসেছে-এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের আশঙ্কা-ভবিষ্যতে দক্ষ মেডিকেল শিক্ষক বা চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া দুরূহ হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমবিবিএস শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক মোট আটটি মৌলিক বিষয় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন ও ভাইরোলজি। বিষয়গুলোকে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাণ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।

অথচ এসব বিষয়ে যারা শিক্ষা দেবেন, সেই শিক্ষকের সংখ্যাই খুবই অপ্রতুল। এই মুহূর্তে দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেলে মৌলিক বিষয়ে ৩৬ দশমিক ২০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। আর ৭২টি বেসরকারি মেডিকেলে ৯ হাজার শিক্ষক দরকার হলেও আছে ৪ হাজার ৬২৬ জন।

বছরের পর বছর এই শিক্ষক সংকট থাকলেও কর্তৃপক্ষের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে একাধিকবার শিক্ষক সংকটের বিষয়টি অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অদ্যাবধি তেমন কোনো কার্যকর ফল আসেনি।

অন্যদিকে বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক অবকাঠামোর তথ্য জানাতে বিভিন্ন সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ কলেজই আংশিক তথ্য দিয়েছে। আবার অনেকগুলো কোনো তথ্যই দেয়নি।

বিশেষজ্ঞরা জানান, মেডিকেলের মৌলিক বিষয়ে অধিকাংশ চিকিৎসকই শিক্ষক হতে চান না। কারণ এখানে তাদের নিয়মিত পদোন্নতি হয় না। পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগও কম। বিদ্যমান এই সংকট দূর করতে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের পদোন্নতি নিয়মিত করতে হবে।

এক্ষেত্রে প্রয়োজনে প্রণোদনা, উচ্চশিক্ষাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া জরুরি। যা বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। এসব উদ্যোগ নিলেই শিক্ষক পেশায় আগ্রহী হবেন চিকিৎসকরা।

প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদেরও চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া মেডিকেল কলেজের ওপর মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) সমন্বিত মনিটরিং বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, মেডিকেল কলেজে প্রতি দশজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকতে হয়। কোনো কলেজে ১৪০ জন শিক্ষার্থী হলে নীতিমালা অনুযায়ী ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রত্যেক বিষয়ে ১৪ জন করে শিক্ষক থাকতে হবে। যার মধ্যে এক থেকে দুজন অধ্যাপক, তিনজন সহযোগী, চারজন সহকারী অধ্যাপক এবং বাকি পদগুলোতে প্রভাষক থাকবে।

এ হিসাবে আটটি মৌলিক বিষয়ে ১১২ জন শিক্ষক থাকা উচিত। বেসিক (মৌলিক) বিষয়ে শিক্ষক না থাকলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে ভালো চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ হতে পারবে না। তারা ঈপ্সিত শিক্ষা ও সেবা কোনোটাই দিতে পারবে না। প্রাইভেট-পাবলিক যে প্রতিষ্ঠানই হোক সেখানে বেসিক সাবজেক্টসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষক অন্যান্য সুবিধা না থাকলে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৫০ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। সরকারি মেডিকেলে বেসিক সাবজেক্টে ১ হাজার ৯৯৭টি পদের মধ্যে ৭২৩টি পদ শূন্য রয়েছে। যার মধ্যে অধ্যাপকের ২০৪টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১৩২টি শূন্য।

একইভাবে ৩৫২টি সহকারী অধ্যাপক পদের ১৫৬টি, সহযোগী অধ্যাপকের ২৫১টি পদের মধ্যে ৯৪টি শূন্য রয়েছে। এছাড়া কিউরেটরের ৪৮ পদের মধ্যে ১৬টি, লেকচারার বা প্রভাষকের ১ হাজার ১৩৫টি পদের মধ্যে ৩২৪ এবং মেডিকেল অফিসারের সাতটি পদের মধ্যে একটি ফাঁকা রয়েছে।

সবমিলে মৌলিক বিষয়ে শিক্ষকের ১ হাজার ৯৯৭টি পদ থাকলেও ৭২৩টি শূন্য। হিসাব করে দেখা গেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষকের পদ ফাঁকা রয়েছে।

জানা যায়, সম্প্রতি শিক্ষক সংকটে বরিশালে সরকারি শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে এমএস কোর্সের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ডিপ্লোমা কোর্স চালু থাকলেও শিক্ষক সংকটের কারণে তাও মুখ থুবড়ে পড়ছে।

কলেজ সূত্র জানিয়েছে, কলেজে পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষক-চিকিৎসক আছেন মাত্র তিনজন। বাকি যারা আছেন তারা সহযোগী এবং সহকারী অধ্যাপক। তাও আবার মঞ্জুরিকৃত পদের প্রায় অর্ধেক শূন্য। এর ওপর ভর করেই বর্তমানে শুধু ১০টি বিভাগে এমফিল, ডিপ্লোমা এবং ডিএমআরডি কোর্স চালু রয়েছে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, মেডিকেলে শিক্ষায় মৌলিক বিষয় ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের ফাউন্ডেশন হিসাবে কাজ করে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি সব কলেজেই শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। দূরের কলেজগুলোয় এই সংকট সবচেয়ে বেশি। কারণ বেসিক সাবজেক্টে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ কম। তাই অনেকে শিক্ষকতায় আসতে চান না। এটি দূর করতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন আসন বাড়াতে হবে। আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও ইনসেনটিভ চালু করলে অন্যরা আগ্রহী হবে।

পাশাপাশি পদোন্নতির বিধান শিথিল করা, উচ্চশিক্ষার সহজ সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হবে।

অন্যদিকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে বেসিক সাবজেক্টসহ সব বিষয়েই শিক্ষক সংকট চরমে। তবে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হলেও তেমন সাড়া দিচ্ছে না কলেজগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, ৭২টি বেসরকারি মেডিকেলের মধ্যে চলতি আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের ৩৩টি, চট্টগ্রামের ১০টি, রাজশাহীর ছয়টি, খুলনা ও সিলেটের চারটি এবং রংপুরের একটিসহ ৫৮ কলেজ শিক্ষকের তথ্য দিয়েছে। বাকি ১৪টি তথ্য দেয়নি।

৫৮ বেসরকারি কলেজে ৮৯০ জন অধ্যাপক, সহযোগী ৮৯৫, সহকারী ৭৯৯, কিউরেটর ৭৩ এবং ১ হাজার ৯৬৮ প্রভাষকসহ ৪ হাজার ৬২৬ জন শিক্ষক রয়েছে। বেসিক বিষয়ে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি থাকায় কলেজগুলো পৃথকভাবে শিক্ষক সংখ্যার তথ্য দেয়নি বলে জানা গেছে।

বেসরকারি মেডিকেলে শিক্ষার্থীদের জন্য ৬ হাজার ৪০০টি আসন। সে অনুযায়ী ৯ হাজার শিক্ষক দরকার রয়েছে। কিন্তু আছে ৪৬২৬ জন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষক ও অবকাঠামো সংকটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে বেসরকারি আইচি মেডিকেল কলেজে ভর্তি নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপরও চলতি শিক্ষাবর্ষে কলেজটি শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। আইন অনুযায়ী কলেজটিতে বেসিক বিষয়ে শতাধিক শিক্ষক দরকার।

কিন্তু এনাটমিতে সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক পদে একজন করে এবং তিনজন প্রভাষক রয়েছেন। বায়োকেমিস্ট্রিতে সহযোগী ও অধ্যাপক পদে একজন করে এবং তিনজন প্রভাষক রয়েছেন। কমিউনিটি মেডিসিনে সহকারী ও অধ্যাপক পদে একজন করে এবং দুজন প্রভাষক রয়েছে। ফার্মাকোলজিতে সহকারী ও অধ্যাপক পদে একজন করে এবং একজন প্রভাষক রয়েছে।

ফরেনসিক মেডিসিনে একজন করে সহকারী ও অধ্যাপক এবং দুজন প্রভাষক রয়েছে। ফিজিওলজিতে সহকারী, সহযোগী ও প্রভাষক পদে একজন করে শিক্ষক থাকলেও অধ্যাপকের পদ শূন্য। মাইক্রোবায়োলজিতে একজন সহযোগী অধ্যাপক ও একজন প্রভাষকসহ সব বিষয়ে ৫১ জন শিক্ষক রয়েছে।

আরও জানা গেছে, গত বছরের ২৯ অক্টোবর বেসরকারি ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজে ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেখানে এনাটমি বিষয়ে কিউরেটর, সহযোগী, সহকারী ও অধ্যাপক পদে একজন করে এবং চারজন প্রভাষক রয়েছে। বায়োকেমিস্ট্রিতে সহযোগী অধ্যাপক ও কিউরেটর পদশূন্য রেখে মাত্র চারজন শিক্ষক পাঠদান করছেন।

কমিউনিটি মেডিসিনে একজন অধ্যাপক ছাড়া বাকি শিক্ষকের পদ শূন্য। সাধারণ বিষয় সাইকোলজিতে একজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন অধ্যাপক ও দুজন প্রভাষক রয়েছে। সবমিলে মাত্র ১৬ জন শিক্ষক পাঠদান করছে।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ যুগান্তরকে বলেন, বেশকিছু সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও শিক্ষকের পদ তৈরি হয়নি। অথচ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করা অনেক বিশেষজ্ঞ রয়েছে। তাদের পদায়ন করা হলে শিক্ষক স্বল্পতা কমে যাবে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শিক্ষক নিয়োগদান কম হচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারিতে বেসিক বিষয়ে চরম শিক্ষক সংকট রয়েছে। কারণ অনেকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ব্যয় কমাতে শিক্ষক নিচ্ছে না। এছাড়া বেসরকারিতে শিক্ষকদের পদোন্নতি নীতিমালা ও কমন সার্ভিস রুল না থাকায় অনেকে আগ্রহী হচ্ছে না। এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএমডিসির মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে নজরদারি বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন-এমন অনেক চিকিৎসক রয়েছে। কিন্তু ধারাবাহিক পদোন্নতি না থাকায় সংকট দূর হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে দেরি হওয়ায় এমনটা হচ্ছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুই অধিদপ্তরের মধ্যে একটি কমিটি করে সমন্বয়ের ভিত্তিতে দ্রুত শিক্ষক সংকট করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া ল্যাবরেটরি, অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

সুত্র: যুগান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *