বিএমইউতে বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস ২০২৫ উদযাপিত
দেশের রোগীদের নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবায় পথপ্রদর্শক হতে হবে বিএমইউকে: অধ্যাপক ডা. মোঃ সায়েদুর রহমান
নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বিএমইউ অঙ্গীকারাবদ্ধ: অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম
জ. ই বুলবুল : প্রধান প্রতিবেদক
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর পদ মর্যাদায় নিযুক্ত অধ্যাপক ডা. মোঃ সায়েদুর রহমান বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শুধু নিজ প্রতিষ্ঠান নয় বরং দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সকল হাসপাতাল, ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহে কীভাবে রোগীদের নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় সেক্ষেত্রে উদহারণ তৈরি করতে হবে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বিএমইউ)। দেশের রোগীদের নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবায় পথপ্রদর্শক হতে হবে বিএমইউকে। বিএমইউ এর কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। রোগীর নিরাপত্তা, নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বেশকিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে নিরাপদ চিকিৎসক ও নার্স তৈরি, আন্তর্জাতিক মান মেনে প্রমাণভিত্তিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা, রোগ প্রতিরোধের দিকে গুরুত্ব দেয়া, যে সকল রোগ প্রতিরোধযোগ্য তা প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগীতে পরিণত হওয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করা, গাইডলাইন তৈরি ও তা অনুসরণ করা, এসওপি মেনে চলা, মানুষ অনেক জানা বিষয় কেন চর্চা করেন না, তার কারণ খুঁজে বের করা, সংক্রমণ প্রতিরোধ করা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব অনেক। কীভাবে দেশের রোগীদের নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় তার নীতিমালা তৈরি, পদ্ধতি আবিষ্কার, দেশের সমগ্র স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে রোগীদের নিরাপদ সেবা প্রদানের বিষয়ে সু চিন্তিত মতামত প্রদানসহ দিক নির্দেশনামূলক গাইডলাইন তৈরি এবং রোগীর সার্বিক নিরাপত্তায় পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে হবে বিএমইউকে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশা, রোগী হাসপাতালে আসলে চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে রোগীর সার্বিক নিরপাত্তায় দেশব্যাপী আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বুধবার ১৭ সেপ্টেম্বর বিএমইউ এর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের লেকচার রুমে বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষে বিএমইউ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
দিবসটি উপলক্ষে বিএমইউ ক্যাম্পাসে একটি বর্ণাঢ্য র্যালিও বের হয়।
‘শুরু থেকেই রোগীর নিরাপত্তা (Patient Safety From The Strat!)’ এই স্লোগান নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে বিএমইউ এর মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম বলেন, অনিরাপদ বিষয় থেকে রোগীদেরকে মুক্তি দিতে হবে। সারা দেশের সকল পর্যায়ে রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে নীতিমালা তৈরি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ে বিএমইউকে ভূমিকা রাখতে হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রোগীদের জন্য নিরাপদ করতে জনসচেতনতা তৈরি, স্বাস্থ্য জনবলের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, সংক্রমণ প্রতিরোধে দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে রোল মডেলে পরিণত হওয়া, গুণগত মানের উন্নয়ন, প্রমাণভিত্তিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা, যথাযথ প্রটোকল অনুসরণ করা, যথাযথ প্রশিক্ষণের আয়োজন, প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করাসহ আগামী দিনে সমগ্রদেশে নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বিএমইউ অঙ্গীকারাবদ্ধ।
‘প্রতিটি নবজাতক ও প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ চিকিৎসা ও সেবা’ থিম নিয়ে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বিএমইউ এর উদ্যোগে নবজাতক বিভাগসহ শিশু অনুষদভুক্ত বিভাগসমূহ ও শিশুদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর চিকিৎসাসেবা প্রদান ও নিরাপদ চিকিৎসা নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ এই সেমিনারে ‘ইনফেকশন প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল (আইপিসি), বিমইউ পারপেক্টিভ’ বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ ও বাস্তবসম্মত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমইউর সম্মানিত প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মোঃ আবুল কালাম আজাদ। এতে তিনি রোগীর নিরাপত্তায় আইপিসি কতটা জরুরি তা তুলে ধরার পাশাপাশি সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের প্রকৃত অবস্থা, জানার সীমাবদ্ধতা, চ্যালেঞ্জসমূহ ও উত্তোরণের উপায়সমূহ নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেন।
বিএমইউ এর সম্মানিত প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মোঃ মুজিবুর রহমান হাওলদার তার বক্তব্যে স্বাস্থ্যসেবার সকল পর্যায়ে রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তিনি তাঁর বক্তব্যে একটি সুস্থ ও সুস্বাস্থ্যবান ভবিষ্যত প্রজন্ম নিশ্চিত করতে নবজাতক ও শিশুদের নিরাপদ চিকিৎসা ও সেবার উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশিদ বলেন, রোগী নিরাপত্তা এটা রোগীদের অধিকার। চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলেরই প্রচেষ্টায় এটা নিশ্চিত করা সম্ভব। রোগীর নিরাপত্তা শুধু চিকিৎসকই নিশ্চিত করবেন বা অনাকাঙিখত কিছু হলে শুধু ডাক্তারই দায়ী এই ভ্রান্ত ধারণাও দূর করতে জনসচেতনতা তৈরি করাটাও জরুরি।
ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ) এর সভাপতি মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, রোগী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যারা মা হবেন, মা হতে যাচ্ছেন তারাসহ চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের সচেতন করতে হবে। জাতীয় পর্যায় থেকে প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ, ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত করা, নিরাপদ সার্জারি করা, চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার সকল পর্যায়ে সঠিক মান নিশ্চিত করাসহ রোগীর নিরাপত্তাকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে কোনোভাবেই রোগীর ক্ষতি না করে নবজাতক ও শিশুদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের উপর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিশু অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিয়ার রহমান এবং নিওন্যাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ আব্দুল মান্নান।
গুরুত্বপূর্ণ এই আয়োজনে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএমইউ এর সম্মানিত কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মোঃ নজরুল ইসলাম, প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ, পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নোমান মোহাম্মদ মোছলেহ উদ্দীন, পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. এরফানুল হক সিদ্দিকী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ডা. আহমেদ জামশীদ মোহাম্মদ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ।
অনুষ্ঠানে তারা বলেন, এই দিবস উদ্দেশ্য হলো মানুষের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানো, বৈশ্বিক বোঝাপড়া উন্নত করা এবং রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করা। প্রতিটি নবজাতক ও প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ সেবা রোগীদের জন্য নিরাপদ চিকিৎসা নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার, নবজাতক ও শিশুদের জন্য এটির গুরুত্ব আরো বেশি।
অনুষ্ঠানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশে রোগী নিরাপত্তা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রোগী নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। হাসপাতালে নিয়মিতভাবে মান যাচাই বা পর্যবেক্ষণ করা হয় না। অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার ঘাটতি আছে। ভুল হলে তা স্বীকার না করা বা রিপোর্ট করতে অনীহা রয়েছে, যা সংস্কৃতিগত সমস্যা। রোগী ও পরিবারের সচেতনতা, তথ্য জানার সুযোগ এবং অংশগ্রহণ অনেক ক্ষেত্রে কম। বাজেট ও পর্যাপ্ত জনবল প্রয়োজনের তুলনায় কম। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে পর্যাপ্ত সমন্বয় নেই। এছাড়া বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় একটি বড় সমস্যা। চিকিৎসা, ওষুধ, অপারেশন বা চিকিৎসার সময় কোনো ভুল বা ক্ষতিকর ঘটনা ঘটলে খরচ আরও বেড়ে যায়। এতে রোগীর পরিবারকে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয়, যা তাদের জন্য অনেক কষ্টকর হয়। এর প্রভাব পুরো সমাজের অর্থনীতির ওপরও পড়ে। এছাড়াও এই ধরণের ভুলের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অপ্রয়োজনীয় খরচ ও কাজের অকার্যকারিতা তৈরি হয়। তাই রোগী নিরাপত্তা শুধু স্বাস্থ্যসেবার জন্য নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পাদনায়: ডা. সাইফুল আজম রঞ্জু।